
গ্যাস সরবরাহ ও বায়ুমান উন্নয়নে বাংলাদেশকে ৬৪ কোটি ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক
নিজস্ব প্রতিনিধি
বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও দুষণ রোধে বায়ুমান উন্নয়নে ৬৪ কোটি ডলারের দুটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালনা পর্ষদ।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জ্বালানি খাতে নিরাপত্তা জোরদার প্রকল্পে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার জন্য ব্যয়-সাশ্রয়ী অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে গ্যাস সরবরাহ নিরাপত্তা জোরদার করতে ৩৫ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে বায়ুমান উন্নয়ন প্রকল্পে ২৯ কোটি ডলার দেওয়া হবে।
জ্বালানি খাত নিরাপত্তা জোরদার প্রকল্পে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) একটি গ্যারান্টি ব্যবহার করে সাত বছরের মধ্যে ২১০ কোটি ডলার পর্যন্ত বেসরকারি পুঁজি সংগ্রহ করার কথা রয়েছে। এর ফলে নতুন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি সম্ভব হবে।আইডিএ গ্যারান্টির সহায়তা পেট্রোবাংলার আর্থিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে এবং এলএনজি সরবরাহ নিরাপদ করবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেন।
মূলত, বাংলাদেশে যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করা হয় তার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি অংশ এলএনজি আমদানিনির্ভর। এ ছাড়া, দেশের মোট গ্যাসের প্রায় ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহার হয়, তাই সরবরাহে ঘাটতি হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানির জন্য অর্থ দেওয়ার নিশ্চয়তা ও কার্যকর মূলধনের ব্যবস্থা থাকবে, ফলে ব্যয়বহুল স্পট মার্কেট গ্যাস আমদানির (তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে স্বল্পমেয়াদে গ্যাস কেনা) ওপর নির্ভরতা কমাবে।
অন্যদিকে, বায়ুমান উন্নয়ন প্রকল্পে ২৯ কোটি ডলার সহয়তা দেওয়া হবে। এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের বাতাসের মান উন্নয়ন করতে একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণের কথা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে এক লাখ ৫৯ হাজারের বেশি অকালমৃত্যু ঘটেছে। এতে সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮ দশমিক ৩ শতাংশের সমান।
ঢাকা শহর বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি। শহরটিতে বার্ষিক ফাইন পার্টিকুলেট ম্যাটারের (পিএম ২.৫) মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমান নির্দেশিকার তুলনায় ১৮ গুণ বেশি। প্রকল্পটি পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ককে নতুন ও উন্নত স্টেশনের মাধ্যমে শক্তিশালী করবে বলে জানানো হয়েছে।
এ ছাড়াও, শিল্পকারখানার মূল দূষণ উৎসের বাস্তব সময় নিরীক্ষণের জন্য এই প্রকল্পের আওতায় স্বয়ংক্রিয় নির্গমন নিরীক্ষণ প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে সহায়তা করা হবে। এই স্বয়ংক্রিয় নিরীক্ষণ ব্যবস্থার সমন্বিত নেটওয়ার্কের ভিত্তিতে নির্গমন সীমা বাস্তবায়ন ও প্রধান উৎসগুলো থেকে সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ নিশ্চিত করা হবে।
এই প্রকল্পে যানবাহনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা হবে এবং ৪০০টি পুরনো দূষণকারী ডিজেল বাসের পরিবর্তে নতুন, শূন্য-নির্গমনক্ষম ইলেকট্রিক বাস চালু করা হবে। এই বাসগুলো একক অপারেটরভিত্তিক ফ্র্যাঞ্চাইজ মডেলের অধীনে পরিচালিত হবে যাতে সেবার মান উন্নত হয়। ইলেকট্রিক বাসগুলোর জন্য চার্জিং, পার্কিং এবং রক্ষণাবেক্ষণের ডিপো নির্মাণ করা হবে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন করে পাঁচটি যানবাহন পরিদর্শন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি, অকার্যকর দুটি কেন্দ্রকে সক্রিয় করতে এগুলো উন্নত করা হবে ও কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ যানবাহন পরিদর্শন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এছাড়াও যানবাহন থেকে দূষণ নির্গমন পরীক্ষায় ২০টি ভ্রাম্যমাণ ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে।
পরিবহন খাতে এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার ৭৩৪ মেট্রিক টন প্রাথমিক পিএম২.৫ নির্গমন কমবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর গেইল মার্টিন বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য জ্বালানিনিরাপত্তা ও বায়ুর মান উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। গ্যাস সরবরাহের সংকট ও শহর এলাকায় বায়ুদূষণের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের লক্ষ্যে এ দুই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সহায়ক হবে।’
এ ছাড়া, বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও এনার্জি সেক্টর সিকিউরিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রকল্পের টাস্ক টিম লিডার ওলায়িংকা বিসিরিউ এডেবিরি বলেন, ‘এই প্রকল্প ব্যয়-সাশ্রয়ীভাবে গ্যাস সরবরাহ নিরাপত্তা জোরদার করবে এবং শিল্প ও গৃহস্থালী ব্যবহারকারীদের জন্য নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ নিশ্চিত করবে।তিনি আরও বলেন, ‘নির্ভরযোগ্য গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করে প্রকল্পটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা জোরদারে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।’
তাছাড়া দেশের বায়ুমান উন্নয়নে একটি নতুন ধারার প্রথম প্রকল্প হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রকল্পের টাস্ক টিম লিডার আনা লুইসা গোমেস লিমা।
তিনি আরও বলেন, ‘বায়ু দেশের সীমানা পেরিয়ে চলাচল করে, তাই এককভাবে কোনো দেশ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই প্রকল্প আঞ্চলিক সংলাপ ও তথ্য বিনিময় জোরদারে সহায়তা করবে, যা বায়ুদূষণ হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।’