
আরামদায়ক ডেমু ট্রেন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি এখন ওয়ার্কশপে শিকলবন্দী
এম আর আমিন, চট্টগ্রাম
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে আমদানি করা ২০ সেট ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডেমু) ট্রেনের জায়গা হয়েছে হাসপাতালের (ওয়ার্কশপ) লাইফ সাপোর্টে। এর আগে কয়েকবার অর্থ খরচ করে মেরাতের পরে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এগুলো আর চালানোর কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি/অপা.) মো. নাজমুল ইসলাম। বিদেশি সফটওয়ার ও প্রযুক্তির ফলে রেলের দক্ষ লোকের অভাবে তা চালাতে পারছেনা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে এই প্রকল্পে খরচ করা ৬৫৪ কোটি টাকা হাতে ধরেই গচ্ছা দিয়েছে তৎকালীন কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন শুধুমাত্র মোটা অংকের কমিশন আদায়ের লক্ষে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা না করেই এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ রেলওয়ে চীন থেকে আমদানি করা ডেমু ট্রেন দেশের রেলপথে ২০১৩ সালে চলাচল শুরু করলেও ৫/৬ বছর যাবৎ ওয়ার্কশপে শিকলবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। ২০ সেট ডেমু ট্রেনের মধ্যে ১৮ সেটই এখন অচল।
জানা যায়, আরামদায়ক কম দূরত্বে ভ্রমণের জন্য চীন থেকে আমদানি করা হয় এই ডেমু ট্রেন। ট্রেনগুলোর সামনে-পেছনে দুই দিকেই আছে ইঞ্জিন। স্বল্প দূরত্বে দ্রুত চলাচলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রেনগুলো রেলওয়েতে সংযোজন করা হয়। কেনার সময় চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি ছিল টানা ২০-২৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু ২০১৩ সালের মাঝামাঝি ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করার পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। এরপর থেকে নানা যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই ছিল ২০ সেট ট্রেনে। চলাচল অযোগ্য এসব ট্রেনে আয়ের চেয়ে মেরামত খাতে ব্যয় বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ২০১৯ সাল থেকে ডেমু ট্রেনে যাত্রী পরিবহন সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
রেলওয়ের মেকানিক্যাল বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০ সেট ডেমু ট্রেনের মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকোশেডে আছে ১০ সেট। আট সেট ডেমু ট্রেন ঢাকার কমলাপুর লোকোশেডে, দুই সেট ডেমু ট্রেন পার্বতীপুর লোকোশেডে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের লোকোশেডে থাকা ১০ সেটের মধ্যে এক সেট সচল আছে। আর ঢাকার লোকোশেডে থাকা এক সেট ডেমু ট্রেন সচল আছে। ঢাকার সচল ডেমুটি চলত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে। চট্টগ্রামের ডেমুটি চলত চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেলপথে। দুটি ট্রেন পরিচালনার জন্য লোকোমাস্টার বা এলএম নেই। নেউ গার্ড ও ক্রু। তাই দুই সেট ডেমু ট্রেন কারিগরিভাবে সচল থাকলেও চালানো যাচ্ছে না।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ট্রেন যাচাই-বাছাই না করেই কেনা হয়। আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী নয়। ট্রেনগুলো এ পর্যন্ত যা আয় করেছে তার চেয়ে মেরামত খাতে ব্যয় বেশি।অচল ডেমু ট্রেন মেরামত, যন্ত্রাংশ ক্রয় ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও ওঠে সেই সময়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের তেলবাজ কর্মকর্তাদের কারনে তার কোন সুরাহা হয়নি।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডেমু ট্রেন চালুর ছয় বছরের মধ্যে ইঞ্জিনে অস্বাভাবিক শব্দ, অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া বের হওয়া, গরম হয়ে যাওয়া, লোডসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। তবে দীর্ঘ সময়েও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ট্রেনগুলো একে একে বিকল হয়ে গেছে। অথচ এগুলো কেনার সময় রেলওয়ের যুক্তি ছিল, ডেমু ট্রেনের দুদিকেই ইঞ্জিন থাকায় আলাদা ইঞ্জিনের দরকার হবে না। তাছাড়া বডি হালকা হওয়ায় জ্বালানিও লাগবে কম। সহজেই কম-বেশি করা যাবে গতি, ঝাঁকুনিও হবে কম। স্বল্প দূরত্বে ট্রেনগুলো পরিচালনা করে প্রচুর যাত্রী পরিবহন করা যাবে। যদিও বেশ কয়েকটি ডেমু ট্রেনকে স্বল্প দূরত্বের বদলে দূরপাল্লার রুটে পরিচালনা করে রেলওয়ে। বিকল হয়ে পড়ার পেছনে এটিও একটি কারণ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়তলী কর্মব্যবস্থাপক ( ডিজেল) এতেসাম মো: শফিক জানান, দক্ষ লোকবল সংকটের কারনে এগুলো মেরামত ও অপারেটিং করা যাচ্ছেনা। তবে এগুলো মূলত ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বের যোগাযোগ সুবিধার জন্য উপযোগী। কিন্তু বেশ কিছু অজানা কারণে এবং হঠকারিতায় এসব ট্রেন ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বেও নিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ। মূলত এ কারণেই ট্রেনগুলো অল্পদিনে বিকল হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন,পুরো ট্রেনে বিদেশী সফটওয়্যার থাকায় মেরামত করেও সুবিধা করতে পারছে না দেশের প্রকৌশলীরা। তাই বেশিরভাগ ডেমুর এখন মুমূর্ষু অবস্থায় ওয়ার্কশপে।
ডেমু ট্রেনগুলো একে একে বিকল হয়ে পড়ার বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ‘ডেমু ট্রেন মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ শীর্ষক রেলওয়ের এক প্রতিবেদন উপস্থাপনায় বলা হয়, এসব ট্রেনে উচ্চপ্রযুক্তির সফটওয়্যারনির্ভর মডিউলসহ ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এ সম্পর্কে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের কোনো ধারণা ছিল না। এমনকি এসব মডিউল, যন্ত্রাংশ দেশের বাজারে পাওয়া যায় না। মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তা সংগ্রহ ও সফটওয়্যার প্রোগ্রাম করে ডেমুতে সংযোজন করার প্রয়োজন হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। নষ্ট হয়ে গেলেও ইলেকট্রনিক এসব যন্ত্রাংশ বিশেষ করে মডিউলগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে ডেমু ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়ে।
ট্রেনগুলোর কোনোটির চাকা সচল নেই, ভেঙে গেছে জানালা। কোনো ট্রেনের জানালার কাচও অবশিষ্ট নেই। ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে আছে বহু আগেই। ভেতরের যন্ত্রাংশ, লাইট-ফ্যান খুলে নেওয়ায় প্রতীকী ট্রেন হিসেবেই অবশিষ্ট আছে এগুলো।
ট্রেনগুলো বন্ধ থাকা অবস্থায় যাত্রী পরিবহন খাতে আয় সম্পূর্ণ বন্ধ থাকত। আর এই সুযোগে রেলওয়ের দুর্নীতিবাজ একটি চক্র মেরামত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। বছর বছর মেরামত খাতে বিপুল অর্থ গচ্চা গেলেও ট্রেনগুলো শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্তই রয়ে গেছে। রেলওয়ের পাহাড়তলী কারখানা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, মেরামত বাবদ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪০ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডেমুর জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ কেনা বাবদ ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪১ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। দুই অর্থবছরে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৭৮১ টাকা ব্যয় হলেও কোনো কাজে আসেনি। অথচ ট্রেনগুলো এক দিন চললে তিন দিন বন্ধ থাকত। চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম-বিশ্ববিদ্যালয় রেলপথে চলাচল করলেও বহু দিন থেকে বন্ধ। একসময় চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে চলাচল শুরু করলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেনগুলোর বড় অংশ মেরামত হতো চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকোশেডে। কিছু মেরামত কাজ চলে পার্বতীপুর কারখানায়। রেলওয়ের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ডেমুতে জ্বালানি খাতে বিপুল তেল ব্যবহার করার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চলাচল বন্ধ থাকার সময়ই দুই সেট ডেমু ট্রেনে ১ হাজার ৭১২ লিটার জ্বালানি তেল ও ৩২২ লিটার লুবঅয়েল ব্যবহার দেখানো হয়েছে। বন্ধ থাকা দুটি ডেমু ট্রেনের বিপরীতে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয় দেখানো হয়। যা ডেমু খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি/অপা.) মো. নাজমুল ইসলাম বলেন দীর্ঘদিন ধরেই ডেমু ট্রেনগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। মেরামত বা চলালের কোন সিদ্ধান্ত এখনো পর্যন্ত হয়নি। দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, সেই সময়ে যারা কেনাকাটায় বা মেকানিক্যালের দায়িত্বে ছিলেন তারা বলতে পারবেন।