ডার্ক মোড
Thursday, 28 March 2024
ePaper   
Logo
”সর্বনাশা বায়ুদূষণের দায় ও নিয়ন্ত্রণের পথ অন্বেষণ

”সর্বনাশা বায়ুদূষণের দায় ও নিয়ন্ত্রণের পথ অন্বেষণ" শীর্ষক সেমিনার

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত বাতাসের শহর। শুধু ঢাকা নয় অন্য বড় শহরগুলোর একই অবস্থা। বায়ুদূষণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য। বায়ু দূষণের উৎস সকলের জানা। সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বাস্তবে বায়ু দূষণের পরিস্থিতির উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) আজ ২১ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখ সকাল ১১ টায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে “সর্বনাশা বায়ুদূষণের দায় ও নিয়ন্ত্রণের পথ অন্বেষণ" শীর্ষক একটি সেমিনার আয়োজন করেছে।

সেমিনারে ধারনাপত্র উপস্থাপন করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী। বায়ু দূষণ তৈরির সাথে যুক্ত সংস্থা/প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি রাশেদ। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বিষয়ে আলোচনা করেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জনাব রাজেকুজ্জামান রতন। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন জনাব আবু নাসের খান, চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।

ধারণাপত্র

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বায়ুর মান ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ঢাকা একটি অন্যতম দুষিত বায়ুর নগরী হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। বিগত ১০ জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার সর্বোচ্চ বায়ুমান(AQI--একিউআই) ছিল যথাক্রমে ৪৫১,৪৭৪,৬৩৭,৫৫৯,৩৬৩,৪৭৯,৩১৬,২৩৩,২৩৮,৩০৭ এবং ৩১৪।

বায়ুমানের এই পরিমাপ Accuweather সংস্থার সুত্রে প্রাপ্ত। Accuweather নিউইয়র্ক ভিত্তিক একটি সংস্থা। ১৯৬২সাল থেকে সংস্থাটি বৈশ্বিকভাবে বায়ুমানের তথ্য সরবরাহ করে আসছে। একিউআই দ্বারা বায়ুর মানের অবস্থা বোঝানো হয়। বায়ুমান একিউআই(AQI) ০--৫০ হচ্ছে ভালো( Good), ৫১--১০০ হলো মধ্যমমানের(Moderate), ১০১--১৫০ হচ্ছে সংবেদনশীল ব্যক্তিদের জন্য অস্বাস্থ্যকর(Unhealthy to Sensitive persons), ১৫১--২০০ হচ্ছে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর(Unhealthy), ২০১--৩০০ হলো অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর(very Unhealthy), ৩০১+ হচ্ছে বিপদজনক(hazardous)।

বায়ুমান বিপদজনক পর্যায়ে উপনীত হলে- সবাইকে ঘরের বাইরে বের হতে এবং কাজকর্ম করতে মানা করা হয়। ঘরের জানালা দরোজা বন্ধ রাখতে বলা হয়। বায়ুমান অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হলে-- যারা হাঁপানি ও নানাধরণের শ্বাসতন্ত্রীয় রোগী এবং সংবেদনশীল তারা বাইরে বের হবেন না।

অন্যেদের জন্য বের না হওয়া এবং বাইরে শারীরিক শ্রমের কাজ না করা উত্তম। অস্বাস্থ্যকর বায়ুমানের সময় সংবেদনশীল ব্যক্তিরা পারতঃপক্ষে বাইরে বের হবেন না এবং অন্যেরা বাইরে শারীরিক কাজ তেমন করবেন না। বায়ুর মান ১০১ --১৫০ হলে সংবেদনশীল ব্যক্তিরা সাবধানে থাকবেন। তাদের জন্য বাইরে বের না উত্তম। বায়ুমান মধ্যম থাকলে কেবলমাত্র অতিসংবেদনশীলগণকে সাবধানে থাকতে হয়।

দুষিত বায়ুতে বাস করলে তাৎক্ষণিক অসুস্থতা থেকে শুরু করে নানাধরণের দীর্ঘমেয়াদী অসুখ হতে পারে। এরমধ্যে হাঁচিকাশি,নাকের অ্যালার্জি,শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমণ থেকে নিউমোনিয়া, টিবি, ফুসফুসের ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ,হৃদরোগ, কিডনি ও লিভারের রোগ, বন্ধাত্ব্য,গর্ভপাত, শিশুর বিকাশ সমস্যা, স্বল্প ওজনের বাচ্চা প্রসব, অকাল প্রসবসহ আরো নানাবিধ রোগ রয়েছে। দুষণের প্রধান উৎসগুলো হচ্ছে -- নানাধরণের নির্মাণ প্রকল্প, ইটভাটা, মোটরযানের ফিটনেসের অভাব, নিম্নমানের মোটর জ্বালানি, নগরের ভিতরের শিল্পকারখানা, বানিজ্যিক, অফিস ও গার্হস্থ্য বর্জ্য ইত্যাদি।

বায়ুদূষণের দায় কেবলমাত্র একপক্ষের নয়,এই দায় প্রকৃতপক্ষে বহুপক্ষের উপর বার্তায়। যেমন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা ব্যক্তিগন 'পরিবেশ রক্ষার শর্তাদি' মেনে কাজ করছে না। এবিষয়টি যাদের দেখভাল বা নিয়ন্ত্রণ করা দায়িত্ব তারা দায়িত্ব পালন করছে না।

মোটরযানের ফিটনেস, জ্বালানি তেলের মান,ইটভাটাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই দৃশ্য বিরাজ করছে। বাণিজ্যিক, অফিস ও গার্হস্থ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি এখনো গড়ে উঠেনি। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলার একটি অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। শিল্পকারখানা শহরের ভিতরে থাকতে পারে না। কিন্তু ঢাকায় সেগুলো দিব্যি রয়েছে। সবমিলিয়ে বলা যায়-- দুষণ তৈরির যুক্ত প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি,নজরদারি/নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সকলকেই কমবেশি দায় স্বীকার করতে হবে।

দ্রুত বায়ুদূষণ রোধ করতে হলে হাইকোর্টের নির্দেশ আশু বাস্তবায়ন করা জরুরি। পরে সবকিছু বিবেচনা করে বায়ুদূষণ রোধে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ২০২১সালের জানুয়ারি মাসে
বায়ু দুষণ রোধে হাইকোর্ট নয় দফা নির্দেশে প্রদান করে। সেগুলো হচ্ছে –

১. ঢাকা শহরের মধ্যে বালি বা মাটি বহনকারী ট্রাকগুলোকে ঢেকে পরিবহন করা।

২. যেসব জায়গায় নির্মাণ কাজ চলছে সেসব জায়গার নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা।

৩. ঢাকার সড়কগুলোতে পানি ছিটানোর যে নির্দেশ ছিল, সে নির্দেশ অনুযায়ী যেসব জায়গায় এখনও পানি ছিটানো হচ্ছে না, সেসব এলাকায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া।

৪. সড়কের মেগা প্রজেক্টের নির্মাণ কাজ এবং কার্পেটিং যেসব কাজ চলছে, যেসব কাজ যেন আইন কানুন এবং চুক্তির টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন মেনে করা হয় সেটা ।নিশ্চিত করা

৫. যেসব গড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়ে সেগুলো জব্দ করা।

৬. সড়কপরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির ইকোনোমিক লাইফ নির্ধারণ এবং যেসব গাড়ি পুরাতন হয়ে গেছে সেগুলো চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ।

৭. যেসব ইটভাটা লাইসেন্সবিহীনভাবে চলছে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনও বন্ধ করা হয়নি, সেগুলো বন্ধ করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করা।

৮. পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইকিলিং বন্ধ।

৯. মার্কেট এবং দোকানের বর্জ্য প্যাকেট করে রাখতে এবং তা মার্কেট ও দোকান বন্ধের পরে সিটি করপোরেশনকে ওই বর্জ্য অপসারণ করা।

এরপর ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট নয় দফার সাথে সংযুক্ত আরো তিন দফা নির্দেশেনা দেয়। সেগুলো হচ্ছে --রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পানি ছিটানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় ওপর থেকে পানি ছিটাতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে; যেন রাস্তার পাশের ছোটখাটো গাছে জমে থাকা ধুলা-ময়লা পরিষ্কার হয়। পানির ঘাটতি তৈরি হলে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে পানি সরবরাহ করতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

উচ্চ আদালতের বারো দফা নির্দেশনার কতোটা বাস্তবায়িত হয়েছে সেটা আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু লক্ষ্য করছি বায়ুমান ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। এরমধ্যে আরেকধরণের বাস্তবতার উদ্ভব হয়েছে। বায়ুদূষণের প্রসঙ্গ তোলা হলে একদল সরকার সমর্থক মনে করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার পথ তৈরি করা হচ্ছে।

অন্যদিকে সরকারবিরোধী আরেকদল এটাকে সরকারের ব্যর্থতার উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায়। এই দু'পক্ষের কারো সাথেই আমরা একমত নই। উন্নয়ন কাজ চলাকালে দুষণ বাড়ার সম্ভবনা তৈরি হবে। তবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করেই দুষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

মানুষকে সুস্থ, আনন্দময় এবং ভালো রাখার জন্য আমাদের সকল আয়োজন। সেই মানুষ যদি দুষিত বাতাস বুকে টেনে নিয়ে অসুস্থ, রোগাক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে উন্নয়নের সকল আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে। অতএব বায়ুদূষণের লাগাম শক্তহাতে টেনে ধরার সময় এখন এবং এখনি।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন