ডার্ক মোড
Saturday, 20 April 2024
ePaper   
Logo
৩-এ পারেনি লাগছে ৮, ব্যয় বেড়েছে শতভাগ

৩-এ পারেনি লাগছে ৮, ব্যয় বেড়েছে শতভাগ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে কাছের জেলা নারায়ণগঞ্জ। এই জেলাটি বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবেও পরিচিত। ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে মানুষের যাতায়াত বেশি। যদিও যানজটে ঠাসা ঢাকায় বাসে পৌঁছতে অনেক সময় ব্যয় হয়। তবে রাজধানীতে অনেক কম সময়ে ট্রেনে পৌঁছানো সম্ভব।

কিন্তু এই রুটে বৃটিশ আমলে নির্মাণ করা রেলপথ অনেক আগেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। সেজন্য জুরাইন থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত একটি নতুন ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ করে পুরো রেলপথ ডাবল লাইনের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে।

কিন্তু বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো, নকশা পরিবর্তন, ব্যয় বৃদ্ধি— এসব যেন রেলওয়ের নিয়মে পরিণত হয়েছে। তিন বছর মেয়াদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আট বছর লেগে যাওয়ার নজির যেমন রয়েছে, তেমনি শতভাগ ব্যয় বাড়ানোর উদাহরণও সৃষ্টি করেছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশে রেলওয়ের এই প্রকল্পটির নাম ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ’।

মেয়াদ ছিল তিন বছর। কিন্তু ১৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের এই প্রকল্প আট বছরেও শেষ করা যায়নি। বরং আরেক দফা মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যদিও রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, প্রকল্পটির জমি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। সেই সমস্যা এখন কেটে গেছে, তাই দ্রুত এগিয়ে চলছে কাজ।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সূত্রানুযায়ী, ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্পে অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি- একনেক। তিন বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে এর ব্যয় ধরা হয় ৩৭৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকারের অনুদানের অর্থের পরিমাণ ২৪৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আর বাকি ১২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করার কথা।

কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কিছু জটিলতা সামনে আসায় পূর্ব পরিকল্পনায় সংশোধন এনে প্রকল্পের ব্যয় আরও ২৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। ফলে বর্ধিত ব্যয়সহ ১৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় দাঁড়ায় ৬৩২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

তবে অতিরিক্ত এই খরচের টাকা দিতে আপত্তি জানায় জাপান। এমনকি তারা এই প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে গেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। যে কারণে এই প্রকল্পের পুরো অর্থই সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে।

এদিকে, প্রকল্প শুরুর চার বছরের মাথায় হঠাৎ-ই ৬৭ দশমিক ১১ শতাংশ ব্যয় কেন বাড়ানোর প্রস্তাব এলো এর ব্যাখ্যা আরডিপিপি’তে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান মিটার গেজ রেললাইনের সমান্তরালে একটি ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ চলছে।

নতুন ডুয়েল গেজ লাইনটি বিদ্যমান লাইনের চেয়ে অনেক উঁচু। এতে বিদ্যমান রেললাইন অসমতল হয়ে পড়বে। স্টেশন, সেতু, প্লাটফর্ম ও লেভেল ক্রসিংয়ে জটিলতা বাড়বে।

ফলে জটিলতা সৃষ্টি হবে ট্রেন চলাচলে। এই পরিস্থিতিতে প্রকল্পটির সমীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কারণ, একটা প্রকল্পের মূল দলিল সমীক্ষা।

খোদ রেলওয়ের কর্মকর্তারাই জানিয়েছেন, প্রকল্পটি নেওয়ার সময়ই পরিকল্পনায় ভুল ছিল। যে ভুলের মাসুল গত আট বছর ধরে দিচ্ছে রেলওয়ে। কেউ কেউ বলছেন, শুরুতেই যদি ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন করার পরিকল্পনা নেওয়া হতো তাহলে খরচের পাহাড়ও হতো না, আবার জাপানও অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়াত না।

সূত্রানুযায়ী, এই প্রকল্পে নতুন একটি প্যাকেজের মাধ্যমে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনটিও ডুয়েল গেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় কমলাপুর থেকে জুরাইন পর্যন্ত বিদ্যমান লাইন ডুয়েলগেজ করা হচ্ছে।

বাকি অংশের মধ্যে জুরাইন থেকে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া পর্যন্ত ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন করা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে আরও যুক্ত হয়েছে তিনটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর জন্য একটি দোতলা ভবন ও ব্যারাক নির্মাণ, রেলওয়ে পুলিশের জন্য একটি ভবন ও ব্যারাক নির্মাণ এবং গেন্ডারিয়া থেকে চাষাড়ার মাঝে পাঁচটি গ্যাং হাট নির্মাণ।

প্রকল্পটিতে বর্তমান জরাজীর্ণ রেললাইনটি সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। যা পরে যোগ করা হয়েছে। এসব কারণেই প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সমস্যার শেষ এখানেই নয়। এর সঙ্গে নতুন জটিলতা দেখা দেয় জমি অধিগ্রহণ। প্রাথমিক পরিকল্পনায় জমি অধিগ্রহণের বিষয় না থাকায় কাজ এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটির দুই কিলোমিটার জায়গা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) হওয়ায় তা অধিগ্রহণ নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় ওই দুই কিলোমিটার পথ বাদ দিয়েই ডাবল লাইনে উন্নীত করার। পাশাপাশি নাসিকের জমির জটিলতা সমাধানেরও চেষ্টা চলতে থাকে।

এতে প্রকল্পটির কাজে একেবারেই ধীরগতি নেমে আসে। ফলে আট বছর শেষে প্রকল্পটির অগ্রগতি এখন ৮০ শতাংশ। এদিকে, সবশেষ বাড়ানো প্রকল্পের মেয়াদও শেষের দিকে। সেজন্য প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় বাড়ানোরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে যদি ফের মেয়াদ ও অর্থ বাড়ানো হয় তাহলে খরচ বেড়ে দাঁড়াবে দেড়শ গুণ।

এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সংবাদদাতাকে বলেন, ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে জমি নিয়ে যে জটিলতা ছিল তা সমাধান হয়ে গেছে। নাসিক ১২ শতাংশ জমি দিতে সম্মত হওয়ায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা নেই।’

প্রকল্পটিতে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের চরম উদাসীনতা, অর্থ অপচয় আর অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘গোটা বিশ্বে সমীক্ষাকে বলা হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের দলিল। মাঠ পর্যায়ে করা সমীক্ষা ধরেই নকশা তৈরিসহ ধাপে ধাপে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়।

কিন্তু বাংলাদেশে হয় এর উল্টো। অনেক প্রকল্পের সমীক্ষা ফিল্ডওয়ার্ক না করে করার কারণে বাস্তবায়নে গিয়ে বিপদে পড়ে। বড় সমস্যা হলো দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে না আসায় বার বার একই ঘটনা ঘটছে। অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রের অর্থ।’

উল্লেখ্য, এক সময়ের জনগুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথটি ১৮৮৫ সালে তৎকালীন বৃটিশ সরকারের সময়ে ইস্টার্ন বেঙ্গল নির্মাণ করে। জানা যায়, রেলের গতি কমে আসায় ১৯৮০ সাল থেকে এই রেলপথের গুরুত্ব কমতে শুরু করে। ১৯৯০ সালের পর রেলের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় স্থান পায় এই পথটি।

আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া জরাজীর্ণ এই পথ দিয়ে করোনার আগেও প্রতিদিন ২৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করতো। ৫ থেকে ১৫ কিলোমিটার গতি বেগে চলাচল করা এই পথে ছোট-খাট ত্রুটিতেই বড় সমস্যার মুখোমুখি হতো ট্রেন। সেকারণে মানুষও এই রুটের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন