ডার্ক মোড
Friday, 29 March 2024
ePaper   
Logo
২৬ বছরেও প্লটের দখল পাননি ৩২ মালিক, মাঠ বানাতে চান কাউন্সিলর

২৬ বছরেও প্লটের দখল পাননি ৩২ মালিক, মাঠ বানাতে চান কাউন্সিলর

কান্ট্রি টুডে ডেস্ক

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন মিরপুরের একটি ভাড়া বাসায়। কর্মজীবনে প্রবেশের পর তার স্বপ্ন ছিল ঢাকায় মাথাগোঁজার মতো একটি ঠাঁই করার। স্বপ্ন সত্যি করতে চাকরিতে ঢোকার চার বছর পরে ১৯৯৬ সালে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মিরপুর সেকশন-১১-এর সি ব্লকে পৌনে দুই কাঠার একটি আবাসিক প্লট বরাদ্দ নেন তিনি। বরাদ্দ পাওয়ার পর ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই স্বপ্ন বাস্তবে আর রূপ নেয়নি।

ফরিদুর রহমান বলেন, ‘মরার আগে নিজের বাড়ি চোখে দেখতে পারবো কিনা জানি না। আমার সঙ্গে আরও যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৯ জন মারা গেছেন। আমাদের বরাদ্দপত্র, ইজারা দলিল, বাস্তব দখল সবই আছে। কিন্তু ওই এলাকার কাউন্সিলর ও প্রভাবশালী এক নেতার কারণে আমরা বাড়ি বানাতে পারছি না। '

তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্লটটি রেজিস্ট্রি, নামজারি করেছি। খাজনা দিয়েছি। এতে আমার প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আমি চাই টিনের একটি ছাপড়া করে হলেও থাকতে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৯৬ সালে মিরপুর-১১ নম্বরে প্যারিস রোডের সি ব্লকে তাদের ‘ঢাকা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের’ (মধ্যবিত্ত কোটা) ৩২টি প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দদানের আগে প্রায় ৭০ কাঠা আয়তনের জলাশয়টি ভরাট করে ঘর বানিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বস্তি গড়ে তোলেন।

বরাদ্দপ্রাপ্তরা জানান, ২০০২ সালে বস্তিবাসীরা আদালতে এক রিট পিটিশন করেন। আদালত ২০১৬ সালে বরাদ্দপ্রাপ্তদের পক্ষে রায় দেন। পরবর্তীতে বস্তি উচ্ছেদ করা হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা ও কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম মানিকের বাধার মুখে কখনোই বাড়ি করা হয়ে উঠেনি এ মালিকদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বরাদ্দ গ্রহীতা বলেন, ‘কাউন্সিলর এখন এখানে একটি মাঠ তৈরি পরিকল্পনার নামে আবারও জমি দখলের চেষ্টা করছেন। এখন মিরপুরে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েকে নিয়ে মাঠ তৈরির আন্দোলন করছেন। মেয়র আতিকুল ইসলামকে এনে ভুল বুঝিয়ে এখানে মাঠ তৈরির ঘোষণাও তার দ্বারা করিয়েছেন।’

এই প্লটের পাশে নিজেকে মাঠ পুনরুদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক ঘোষণা করে বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনশনও করেন উত্তর সিটির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলর। এমনকি সিটি করপোরেশনের বুলডোজার নামিয়ে কিছু জায়গায় কাজও করা হয়।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মিরপুর গৃহ সংস্থান বিভাগ-২-এর এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ' আমরা শুনেছি সিটি করপোরেশন আজ আমাদের বরাদ্দকৃত জায়গায় মাঠ বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তারা আমাদের চিঠি দিয়ে জানায়নি।'

তিনি জানান, সেনপাড়া-পর্বতা মৌজার ২৪৫ দাগের এ জায়গা গৃহায়ন মন্ত্রণালয় ১৯৬০ সালে অধিগ্রহণ করে। ১৯৯৫-৯৬ সালে ৩২ জন ব্যক্তির নামে বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু কাউন্সিলরসহ অন্যান্য দখলদারের বাধায় তারা কেউই বাড়ি করতে পারেননি।

এ বিষয়ে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা বলেন, ‘এখানে কখনও মাঠ ছিল না। এটা ছিল নিচু জায়গা। এখানে ছিল বস্তি। আমার ভাইয়েরও এখানে চারটি ঘর ছিল। বস্তিটি আমার নামে কালা মিয়ার বস্তি নাম পরিচিত ছিল। এখানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের অফিস তৈরি করেছিলাম। পরে এটা ২০১৬ সালে কোর্টের আদেশে ভেঙে ফেলা হয়।’ তিনি জানান, এই জমি ৩২ জন বরাদ্দপ্রাপ্ত মালিকের।

কী বলছেন কাউন্সিলর

অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম মানিক বলেন, ১৯৬৩ সালে ডিআইটির চেয়ারম্যান জি এ মাদানীর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী মিরপুরে ১৪টি মাঠ ছিল। এর একটি এই মিরপুর-১১ নম্বর প্যারিস রোড মাঠ। এই মহাপরিকল্পনা ক্ষতবিক্ষত করে পরবর্তী প্রজন্মকে বঞ্চিত করে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৯৪ সালে কী শর্তে, কেন তাদের বরাদ্দ দিলো এই মাঠে?’

তিনি বলেন, ‘এ প্লটগুলো মূলত বিএনপির গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম মিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে বরাদ্দ দিয়েছিলেন। আমার মতো আওয়ামী লীগারদের বরাদ্দ দেননি। যারা বরাদ্দ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বিক্রি করে চলে গেছেন। হাউজিংয়ের দুষ্টু অফিসাররা এই জমি বরাদ্দ দিলেও বর্তমান ড্যাপে এটিকে খেলার মাঠ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর আমাদের বর্তমান সংসদ সদস্য মহোদয় বলেছেন, প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের অন্য জায়গায় বিকল্প বরাদ্দ দেবেন। আমরা সেই শর্তে রাজি হয়েছি।’

তবে প্লটের বরাদ্দপ্রাপ্তরা কেউ বিকল্প জমি পাওয়ার বিষয়ে কিছু জানেন না।

জহিরুল ইসলাম মানিক দাবি করেন, এক সময় তিনি ছাত্রলীগ করতেন। তবে উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০২০ এ তার হলফনামায় তিনি নিজেকে স্বশিক্ষিত বলে উল্লেখ করেছেন।

নগর পরিকল্পনাবিদের পরামর্শ

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান এ বিষয়ে বলেন, ‘যেহেতু এটা প্রায় ৭০ কাঠার প্লট, এখানে একপাশে চার ইউনিটের আটতলা ভবন করে বাকি অংশে খেলার মাঠ করে দিলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। এতে এলাকাবাসী খেলার মাঠও পাবে, আবার যারা ২৬ বছর বাড়ি করতে পারছেন না তাদের বঞ্চনাও দূর হবে।’

মেয়রের বক্তব্য

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা শহরে মাঠের জায়গা খুবই কম। তাই এলাকাবাসী একটি মাঠের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। আমি সেখানে সংহতি জানাতে গিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, 'সদ্য প্রকাশিত মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় এটিকে একটি খোলা জায়গা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটা দেখেই আমি সেখানে গিয়েছি। এ পরিকল্পনায় সংশোধন ছাড়া তো তারা বাড়ি করতে পারবে না। '

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন