ডার্ক মোড
Friday, 29 March 2024
ePaper   
Logo
ল্যাবের যন্ত্রপাতি ক্রয়: সরবরাহের আগেই ২৪ কোটি টাকা বিল পরিশোধ

ল্যাবের যন্ত্রপাতি ক্রয়: সরবরাহের আগেই ২৪ কোটি টাকা বিল পরিশোধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

কেনাকাটায় অনিয়ম ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে মুখথুবড়ে পড়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ‘পানির গুণগতমান পরীক্ষা শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্প।

পরীক্ষাগারের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ পাওয়ার আগেই প্রকল্প পরিচালকের পছন্দের দুটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২৪ কোটি টাকা বিল প্রদানসহ দরপত্রে নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে এলজিআরডি মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। কেনাকাটায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় অদক্ষতার কারণে সংশ্লিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে ৫২টি জেলায় পানি পরীক্ষাগার স্থাপনের জন্য ১৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪ বছরের প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজের অগ্রগতি তেমন একটা নেই। প্রকল্পটির আওতায় পরীক্ষাগারের জন্য যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক দ্রব্যসহ বিভিন্ন যন্ত্র-সরঞ্জাম কেনার কথা। তবে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও ১ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

প্রকল্পের বিভিন্ন দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে আহবায়ক ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফজলে আজিমকে সদস্য সচিব করে গত ২৩ অক্টোবর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। তদন্ত কমিটি গত ১১ এপ্রিল দুই দফা সুপারিশসহ তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, কার্যাদেশ পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানই প্রথম রানিং বিল প্রদানের পর এর সমপরিমাণ পণ্য বিভিন্ন সময়ে (জুলাই ২০২২ থেকে অক্টোবর ২০২২ এর মধ্যে) সরবরাহ করেছে, যা কার্যাদেশ পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারি চালানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের জেলা পর্যায় অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পণ্য বুঝে পাওয়ার স্বাক্ষর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।

সুতরাং রানিং বিল এবং ইনভয়েস, ডেলিভারি চালান ও পণ্য বুঝে পাওয়ার প্রমাণ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, ক্রয়কারী ক্রয়কৃত পণ্যের কোনো ধরনের সরবরাহ ছাড়াই ক্রয়কারী কার্যাদেশ পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডিকে ১৩ কোটি টাকা ও মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডকে ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৮২ হাজার টাকার প্রথম রানিং বিল প্রদান করেছে, যা সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে ক্রয়কারীর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, টেন্ডার আইডি নম্বর ৬৩৭২৭৮ এবং ৬৮৬৯২৪-এর টেন্ডার ভ্যালিডিটি পিরিয়ড অতিক্রান্ত হয়েছে এবং টেন্ডার দুটি এখনও অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অদক্ষতার কারণে সংশ্লিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ও ক্রয়কারীর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এর আগেও গত বছরের জুলাইয়ে প্রকল্পটিতে টেন্ডার অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খাইরুল ইসলামকে প্রধান করে গঠন করা হয় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। এই অনিয়মের সঙ্গে খোদ প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প পরিচালক সম্পৃক্ত বলে তদন্তের মতামতে উল্লেখ করা হয়। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী একটি প্রতিষ্ঠান স্টার্লিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেড (টেন্ডার আইডি ৬৪৭২৮ এবং ৬৪৬৯২৪) অনিয়মের অভিযোগ তোলে। তাদের দাবি ছিল সর্বনিম্ন দরে ৫ম স্থান থেকে তাদের বাদ দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে ৭ম স্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করা হয়।

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খায়রুল ইসলাম বরাবর লিখিত অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির অপারেশন ম্যানেজার মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, টেন্ডারে অ্যাপ ভ্যালু ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি টেন্ডার বাজেট ২৮ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৪০০ টাকা উল্লেখ করে টেকনোল্যাবকে মনোনীত করা হয়। শহীদুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা যতদূর জানতে পারি যে, প্রকল্প পরিচালক এই টেন্ডার দুটির জন্য কোনো টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেননি। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য তাদের স্পেসিফিকেশন হুবহু টেন্ডারে প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের ঘুষ চাওয়ার অভিযোগও করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ‘পানির গুণগতমান পরীক্ষা শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মুন্সি মো. হাচানুজ্জামান সংবাদদাতাকে বলেন, মালামাল পাওয়ার পরই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু জেলায় জেলায় এগুলো কিছু দিন পর পাঠানোর কারণে তারা রিসিভ করেছে বিল পরিশোধের পর। বিষয়টি তদন্ত কমিটিকে পরবর্তী সময়ে বিলের কপিসহ পাঠানো হয়েছে।

পঞ্চম দরদাতার পরিবর্তে সপ্তম স্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পঞ্চম দরদাতার টেন্ডার ডকুমেন্ট সঠিক ছিল না বিধায় তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। ঘুষ চাওয়ার অভিযোগও ভিত্তিহীন দাবি করেন তিনি।

মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই এবং নানা অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা ঠিক নয়। প্রকল্পের মেয়াদ আরও ১ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন