মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক ফোরাম এখন কোন পথে-১
মোস্তাক মোবারকী
‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির সাংবাদিক ফোরাম’ গঠন করা হয় রাজধানী ঢাকার বংশালে, ১৯৭৭ সালের সেপ্টম্বর দৈনিক সংবাদ কার্যালয়ে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আমি পূনগঠিত ন্যাপ (মোজাফফর) কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক উপকমিটির সম্পাদক নিযুক্ত হই।
এই উপ-কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হাফিজ। ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে অধ্যাপক আব্দুল গফুর, অধ্যক্ষ আশরাফ ফারুকী, বোরহান আহমদ, ইত্তেফাকের ইয়াহিয়া বখত ও কবিরুল ইসলাম একত্রিত হয়ে এ.টি.এম আবদুল মতীন সম্পাদিত ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকায় যোগদান করেন। আমি তখন ন্যাপের সাংস্কৃতিক উপকমিটির সম্পাদক হিসেবে ন্যাপের সার্বক্ষণিক রাজনীতি ছেড়ে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় সিনিয়র রিপোর্টার পদে যোগ দিই।
১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে দৈনিক বাংলা অফিসে নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করতে যাই। পঁচাত্তরের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমি নির্মলদার ১২ নয়াপল্টনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। দৈনিক বাংলার সিনিয়র সাব-এডিটর (কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ) সিপিবির আমিনুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি চা খেতে দিয়ে অনেক বিষয়ে কথা বললেন। তিনিই তখন প্রথম ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকদের একটা বৈঠক ডাকার কথা বললেন। তিনি এ-ও বললেন যে, প্রথমে ছোট্ট পরিসরে আমরা বাম ঘরানার সাংবাদিকরা সংবাদ অফিসে আগে বসব। আমি তার প্রস্তাবে সায় দিয়ে চলে এলাম। দৈনিক মিল্লাদ অফিস তখন পুরানাপল্টনে। আমিনুল ইসলাম ভাইয়ের বাসা তখন ফকিরাপুল বাজারের কাছে নিচতলায়।
আমি মিল্লাতে যোগদান করার পর ন্যাপের পার্টির মেস ছেড়ে দিয়ে উঠেছি তোপখানা রোডের এক মেসে। একদিন দৈনিক বাংলার মোড়ে আমিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি বলেন, খুব শিগগিরই আমরা বামপন্থী কয়েকজন সাংবাদিক সংবাদ অফিসে বসব। তারিখ ঠিক করে তোমাকে জানানো হবে, তখন তুমি আমাদের নির্ধারিত সমমনা লোকজনকে খবর দেবে। কিছুদিন পর তিনি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সন্ধ্যার পর দৈনিক বাংলায় আমকে দেখা করতে বললেন। আমি ‘জি হ্যাঁ’ বলে চলে এলাম।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি কোন এক বুধবার আমি দৈনিক বাংলায় আমিনুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। তিনি কযেকজন সাংবাদিকের নামের একটি তালিকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আগামী রবিবার সকাল ১০টায় আমরা বংশালে সংবাদ অফিসে বসব। সবাইকে খবর দিও। বজলুর রহমান ভাই ও সন্তোষ গুপ্তদার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি যথারীতি সব সাংবাদিককে খবর দিলাম। ওই বৈঠকে ইত্তেফাকের হাবিবুর রহমান মিলন, দৈনিক আজাদের এম.এ করিম, মর্নিং পোস্টের বাহাউদ্দিন আহমদ, দৈনিক বাংলার আমিনুল ইসলাম ও শওকত আনোয়ার সংবাদের বজলুর রহমান, সন্তোষগুপ্ত ও জিএম ইয়াকুব (গোলাম মোহাম্মদ ইয়াকুব) এবং আমি উপস্থিত ছিলাম।
প্রায় ২৫ মিনিটের ওই বৈঠক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকার কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে একটি ফোরাম গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে দৈনিক বাংলার আমিনুল ইসলাম বলেন, আমাদের বামদের কেউ ভোট দিতে চায় না। তাই আওয়ামী ঘরানার একজনকে ফ্রন্টে রেখে আমরা নেপথ্যে কাজ করব। তাছাড়া বামদের স্বভাব হচ্ছে তারা নিজের ক্ষেতের ফসল মিত্রদের ঘরে তুলে দেয়। আমরাও আওয়ামী ঘরানার একজন নেতাকে সামনে এনে ব্যাকে তার পক্ষে কাজ করব। বৈঠকের সভাপতি সন্তোষ গুপ্ত তাঁর মুষ্টিবদ্ধ সিগারেটে সুখ টান দিয়ে বললেন, আমরা আওয়ামী ঘরানার একজনকে নেতা বানাবো, তা ঠিক আছে, তবে খেয়াল রাখতে হবে, তিনি যেন শতভাগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হন। বৈঠকে
স্থির হয়, পরবর্তী সভায় ফোরাম গঠনের রূপরেখা তৈরি করা হবে। জায়গা-জমি সংক্রান্ত একটা জরুরি কাজে শরীয়তপুরে গ্রামের বাড়ি যাই; সেখানে ১৫ দিন থাকতে হয়েছে। একদিন দৈনিক মিল্লাতে আমার কর্মকালের সহকর্মী মানিকগঞ্জের সৈয়দ সরোয়ার আলম চৌধুরীকে নিয়ে বাংলাদেশ টাইমস অফিসে গেলাম।
সরোয়ারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন ‘বামপন্থী নামে খ্যাত সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদের দ্বিতীয় স্ত্রী শিরিন। তিনিই জাহিদভাইর মাধ্যমে সরোয়ারকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য খবর দিয়েছিলেন। বিকেলের দিকে জাহিদভাইর সঙ্গে সারোয়ারের কথা শেষ করে আমরা দৈনিক বাংলা অফিসে আমিনভাইকে সালাম দিতে গেলাম। আমিন ভাই আমাকে দেখেই বললেন, কি হল? তোমাকে কদিন ধরে খুঁজছি, কোথায় ছিলে? বললাম ‘বাড়ি গিয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, আগামী শুক্রবার বিকাল ৪টায় সংবাদ অফিসে আইসো। এবার আর তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমিই সাবইকে খবর দিয়েছি মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য। শুক্রবার বিকাল ৪টায় বাংশালে সংবাদ অফিসে গিয়ে দেখি কোনো সাংবাদিক আসেনি। নিচতলায় টিনশেডে রিপোর্টিংয়ে যেতেই দেখি চিফ রিপোর্টার মজিবর রহমান বাদল একা বসে কি যেন লিখছেন। আমাকে দেখেই বাদলভাই পিয়নকে চা দিতে বললেন। চা খেতে খেতে বাদলভাই বললেন, কবির সাহেব (আহমদুল কবির, ‘সংবাদ’ সম্পাদক) তো ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। কি করছো তোমরা? বললামÑ ইউনিয়ন না, একটা ফোরাম করব। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব সাংবাদিককে নিয়ে এই ফোরাম হবে। কুড়ি মিনিট পর সংবাদের দোতলায় গিয়ে দেখি মিলনভাই আর বজলুভাই গল্প করছেন।
আমাকে দেখেই মিলনভাই বললেন, কি নেতা আপনাদের লোকজন কই? বললামÑ আমিনভাই খবর দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। নিশ্চয়ই লোকজন আসবেন। কথা বলতে বলতে আমিনভাইও শওকত আনোয়ার এলেন। আমিনভাই পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে সংবাদের পিয়নকে দিয়েই বললেন, আমাদের জন্য চা নিয়ে আসেন। বয়স্ক একজন পিয়ন চা এনে পরিবেশন করলেন। আমরা চা খেতেই দেখি জিএম ইয়াকুব ও দৈনিক আজাদের এম এ করিম এসে ঢুকলেন। এরপর আরও কয়েকজন এলেন। আমিনুল ইসলাম এবারও সন্তোষদাকে সভায় সভাপতিত্ব করতে বললেন। তিনি আপত্তি করায় এম এ করিম সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠকের শুরুতেই আমিনভাই দাঁড়িয়ে ফোরামের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করে বললেন, আমরা আগের বৈঠকেই বলেছি যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকরা একটি ফোরাম গঠন করব। এটিকে শিবির প্যানেল বা ফোরাম নাম দেয়া যেতে পারে। সন্তোষ গুপ্ত বললেন, শিবির নাম দেয়া যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকদের ফোরাম নাম দেয়া যেতে পারে। সন্তোষদা’র সঙ্গে সবাই একমত পোষণ করলেন। ফোরামের গঠনপ্রণালী এবং কার্যতৎপরতার উপর বজলুর রহমান বললেন, এটা শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক হবে না। আমরা পেশাগত সামগ্রিক কর্মকান্ডে এই ফোরামের মাধ্যমেই করব। বজলুর রহমানকে ফোরামের আহবায়ক হওয়ার জন্য আমিনুল ইসলাম প্রস্তাব করেন। তিনি এও বলেন, বজলুভাই আমাদের মুরব্বি। উনি আহবায়ক থাকবেন। সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাব নির্বাচনে আমরা আওয়ামী ঘরানার ভাল লোকজনকে নেতৃত্বে নিয়ে আসব। আমরা নেপথ্যে থাকব। কেননা আমরা বামেরা নেতৃত্বে আসতে চাইলে সবাই আমাদের বিরোধিতা করবে।
তাই আমরা নেপথ্যে থেকেই আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকদের নেতা বানাব। আমিনুল ইসলামের সঙ্গে সবাই সহমত হলেন। ওই বৈঠকে বজলুর রহমানকে আহবায়ক করার বিষয়ে ঐকমত্য হল। বৈঠকে বজলু ভাইকে আহবায়ক এম এ করিম হাবিবুর রহমান মিলন ও আমিনুল ইসলামকে সদস্য করা হয়। বজলুভাই সম্পাদকীয় লেখার তাড়া আছে বলে বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
সাংবাদে বৈঠকের দিন বিশেক পর একদিন দৈনিক বাংলা অফিসে যেতেই আমিনভাই বললেন, মোবারকী কোনো খবর জানো নাকি। বললাম না, ‘তিনি বলেন, আমাদের বৈঠকের খবর শুনে অবজারভারের সুচতুর আতিকুর রহমান তার আরামবাগের বাসায় বৃহত্তর আকারে একটি ফোরাম মিটিং করার জন্য আমাদের দাওয়াত দিয়েছে।
ওই বৈঠক হবে আগামী শুক্রবার বাদ জুমা। আমাকে আমিনভাই বললেন, তুমি দাওয়াত পাবে। তবুও তোমার খবরটা দিলাম। আমাদের সবাইকে যেতে হবে। তিনি বললেন, আতিকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। সে নিজেই বলল, আপনাদের বৈঠকের খবর পেয়েছি। ওই বৈঠকই একটু বৃহত্তর আকারে করলে ভালো হয়। আর সে জন্য তার বাসায় সবাইকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছে। অবজারভারের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন, নজরুল ইসলাম। ফরিদপুর বাড়ি হওয়ার সুবাদে আমার সঙ্গে তাঁর ভাল সম্পর্ক। তিনিও একদিন আমাকে আতিকভাইয়ের বাসায় চায়ের দাওয়াতের কথা বললেন। আতিকুর রহমান ছিলেন উত্তরা ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী ও ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের অন্যতম স্থপতি তাহের উদ্দিন ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খুব তীক্ষ্মবুদ্ধির মানুষ আতিকুর রহমান; কৌশলে মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক শফিকুল আজিজ মুকুলকে তার বাসায় পেয়িংগেস্ট করে রেখেছিলেন।
এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকদের বৈঠক যদি তার বাসায় হয়, তাহলে তিনি রাজনৈতিক সমালোচনা থেকে মুক্তি পাবেন। সেই চিন্তা ভাবনা থেকেই তিনি তার বাসায় চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। ইকবাল সোবহান চৌধুরী তখন অবজারভারের ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ইউনিট প্রধান। আর আমি এটিএম আবদুল মতিন সম্পাদিত দৈনিক মিল্লাতের ইউনিট প্রধান।
আতিকুর রহমান অবজারভারের রিপোটিংয়ে কাজ করেন, তিনি সচেষ্ট হলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে প্রমোট করতে। আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিক হিসেবে আমাদের বাম ঘরানার সবাই ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে পছন্দ করতেন। বজলুভাই, সন্তোষ দা, জি. এম ইয়াকুব ও মিলনভাই তাকে পছন্দ করতেন। বজলুভাই ও মিলনভাই তাঁদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে সমর্থন দিয়ে গেছেন।
শুক্রবার আতিকুর রহমানের আরামবাগের বাসায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকদের একটি ফোরাম গঠনের ব্যাপারে সবাই ঐকমত্যে আসেন। আগামী ডিইউজে ও বিএফইউজে এবং প্রেসক্লাব নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক ফোরাম থেকে মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সবাই একমত হন। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বজলুর রহমান। বৈঠকে চা-বিস্কুট খেয়ে সবাই চলে যান।
এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক ফোরামের সূচনা হয়েছে। আশির দশকের শেষপ্রান্তে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। নব্বই দশকের শুরুতে প্রথম ইত্তেফাকের মুহম্মদ শাফিকুর রহমানের সঙ্গে বেবী মওদুদের মনোমালিন্য শুরু হয়। তখনো ইকবাল সোবহান চৌধুরী নিরপেক্ষ ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি শফিকুর রহমানের পক্ষ নেওয়ায় বেবী মওদুদ খুবই ক্ষেপে যান। তখনো পুরানো ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে বেবী ও দৈনিক বাংলার শওকত আনোয়ারের সঙ্গে আমার সু-সম্পর্ক।
একদিন শওকত আনোয়ার আমাকে কিছু কগজ দিয়ে বললেন, এগুলো রেখে দেন। কয়েকদিন পরে এগুলো বেবী মওদুদ নেত্রীকে দিবেন। কাগজগুলো বাসায় নিয়ে দেখলাম। ওই কাগজগুলোয় যে তথ্য, তাতে দেখা যায়, গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার আবেদন সমর্থণ করে (জামায়াতের উদ্যোগে) যে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চলে, সেখানে ইকবাল সোবহান চৌধুরী স্বাক্ষর দিয়েছেন। তিনি ১৯৭১ সালে অবজারভারে রিপোর্টার পদে কাজ করেছেন। পত্রিকার কাটিং এবং তখনকার ৩টি সাদা কালো ছবি। কয়েকদিন পর দৈনিক বাংলার মোড়ে শওকত আনোয়ারের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বললেন, মোবারকী, কাগজগুলোর কথা বেবী মওদুদ জানতে চেয়েছে। আমি তাকে বলেছি মোবারকীর কাছে আছে। আপনার কাছে ওসব কাগজ দেওয়ায় বেবী খুব রাগ করেছে। খবরদার কাগজপত্র ঠিকমত রাখবেন কিন্তু।
কিছুদিন পর একদিন শওকত আনোয়ার কাগজগুলো ফেরত চাইলেন। আমি বললাম, ঠিক আছে কাল নিয়ে আসব। পরে মনে হল, জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে কাগজগুলো দিলে বড়ধরনের সমস্যা হতে পারে। তাই কাগজগুলো পুড়িয়ে ফেললাম। শওকত আনোয়ারকে বলি, স্যরি। কাগজগুলো হারিয়ে ফেলেছি। ৫/৬ দিন পর দেখা হলে বেবী আমার ওপর খুব ক্ষেপে গিয়ে অনেক গালমন্দ করেন। ১৯৮০ সালে ডিইউজে নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী আর প্রতিপক্ষের প্যানেল থেকে সভাপতি নির্বাচিত হলেন আনোয়ার জাহিদ।
সে সময় জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি বিরোধী আন্দোলনের মুখে সভা-সমাবেশের উপর ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ওই ডিইউজের সভাপতি আনোয়ার জাহিদ চেয়েছিলেন সাংবাদিকদের বিক্ষোভ সমাবেশ প্রেসক্লাব চত্তবেরর ভেতরেই হবে। ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আমাদের ফোরামের সাংবাদিকরা কৌশলে ব্যারিকেড ভেঙে রাস্তায় মিছিল করে। মিছিলটি পল্টন মোড়ে এসে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। এসময় তারা কলার ধরে ধরে ইকবাল সোবহান চৌধুরী , সঞ্জয় বড়ুয়া ও আবু তাহের (ইউনিট চিফ, দৈনিক দেশবাংলা) কে পুলিশ ভ্যানে তোলে। দৃশ্যটা দেখা মাত্রই ছুটে এলেন বিবিসির আতাউস সামাদ।
ভ্যানের পাশে দাড়ানো সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ছেড়ে দিন এদের, এখনই।’ অফিসাররা বলেন, ‘ভাই ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছেন কেন! আমরা তো ওনাদের এ্যারেস্ট করিনি। ইটস্ আ ডেটারেন্ট এ্যাকশন।’ রাগান্বিত সামাদ ভাই বলেন, ‘তাহলে কেন গাড়িতে ওঠালেন?’ তর্কাতর্কির মধ্যে পুলিশ ভ্যানটি বিজয়নগরের দিকে যাত্রা শুরু করে। তখন ইকবাল সোবহান ও আবু তাহের লাফ দিয়ে নেমে গেলেন।
ভ্যানে থেকে গেলেন সঞ্জয় বড়–য়া। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনিও লাফ দেন। কিন্তু ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলেন না। চিৎপাৎ হয়ে পড়লেন রাজপথে। হাতেপায়ে জখম হওয়ায় প্রায় সাত দিন শয্যাগত ছিলেন। ওই মিছিল থেকে নির্মল সেন-সহ আমাদের কয়েকজনকে পল্টন পুলিশ বক্সে আটকে রাখে। জিপিও অফিসের সামনেও মিছিলে হামলে পড়ে পুলিশ মিছিলকারী সাংবাদিকদেরদের হাত থেকে প্ল্যাকার্ড ছিনিয়ে নেয়। বেশ কয়েকজনকে লাঠিপেটা করে।
ঘটনার ঘন্টা খানেকের মধ্যে ভাস্কর শামীম শিকদারের স্বামী জাকারিয়া চৌধুরী, যিনি ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের তথ্য উপদেষ্টা, সাংবাদিকদের আন্দোলন প্রশমনের লক্ষ্যে প্রেসক্লাবে এসে পুলিশের বাড়াবাড়ির জন্য ক্ষমা চাইলেন। আটক সাংবাদিকদের ছেড়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা করলেন।
সেদিনকার আন্দোলন ও মিছিলে হামলা পরবর্তী গোটা পরিস্থিতি সামলানোর নেতৃত্বের পুরোটাই দিয়েছিলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী। এরপর অনেক দেন-দরবার করে গিয়াস কামাল চৌধুরী রিয়াজউদ্দিন আহমদ, আমিন আহমেদ চৌধুরী, আমানউল্লাহ কবির ও সৈয়দ জাফরসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ফোরামে যোগ দেন। সে বছর বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজ) নির্বাচনে আমাদের প্যানেল থেকে গিয়াস কামাল চৌধুরীকে সভাপতি ও রিয়াজউদ্দিন আহমদকে মহাসচিব এবং বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ফোরাম থেকে আহমদ হুমায়ুনকে সভাপতি এবং আবেদ খানকে মহাসচিব করে প্যানেল দেয়া হয়। সেই নির্বাচনে আমাদের প্যানেল থেকে রিয়াজউদ্দিন আহমদ মহাসচিব এবং প্রতিপক্ষ প্যানেল থেকে আহমদ হুমায়ুন সভাপতি নির্বাচিত হলেন।
ওই নির্বাচনে আমি কাউন্সিলর এবং বিএফইউজে নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলাম। সে বছর খুলনা থেকে ২ জন কাউন্সিলর ছিলেন- বাসস’র আশরাফউদ্দিন মকবুল ও অবজারভারের আবু সাদেক। চট্টগ্রামের কাউন্সিলর ছিলেন ৮ জন। দিলকুশায় হোটেল পূর্বরাগে চট্টগ্রামের কাউন্সিলররা উঠেছিলেন। তখন ছিল রমজান মাস। সাহ্রি খাওয়ার পর রিয়াজউদ্দিন আহমদ গোপনে আনোয়ার জাহিদ ও আহমদ হুমায়ুনের সঙ্গে মিলে যান। ফলে আমাদের সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী আর জাহিদভাইদের মহাসচিব আবেদ খান পরাস্ত হন। ওই নির্বাচনে আবেদখানকে কৌশলে হারানোর কারণে তিনি পরবর্তী সময় জাহিদ ভাইদের ফোরাম ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরামে যোগদান করেন। পরবর্তী পর্যায়ে গিয়াস কামাল চৌধুরী, রিয়াজউদ্দিন আহমদ আমানউল্লাহ কবির, আমিন আহামদ চৌধুরীও সৈয়দ জাফরেরা তাদের পুরানো ফোরামে ফিরে যান। তখন আমাদের ফোরামে কার্যত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক নেতা কমে গিয়ে অনেকটা শূন্যতা দেখা দেয়।
এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের কট্টর সমর্থকও না আবার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষও না এমন মাঝামাঝি পর্যায়ের নতুন কিছু নেতা একদিকে বেবী মওদুদ এবং অন্যদিকে ইকবাল সোবহান চৌধুরীও মাঝামাঝি পর্যায়ের সাংবাদিকদের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরামে নিয়ে আসেন। তখন বেবী ও ইকবাল সোবহান চৌধুরী দুজনের পৃথক দুটি গ্রুপ তৈরি হয়।
এই দুজনই মঝামাঝি পর্যায়ের সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মধ্যে ‘আমার লোক’ তৈরি করেন। সত্যিকারভাবে ভাল সাংবাদিকরা ইউনিয়ন করতে আসতে চাননি। উদাহরণ হিসেবে আলতাফ মাহমুদ একজন মাধ্যম মানের রিপোর্টার। দৈনিক খবর তখন আমাদের একটি বড় ইউনিট, ওই ইউনিট থেকে ইউনিয়নে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আলতাফ মাহমুদের অফিসে হাজিরার বিষয়টি খুব শিথিল করে দিলেন দৈনিক খবরের নির্বাহী সম্পাদক আওয়াল খান, অন্যতম পালাপ্রধান আবু তাহের ও প্রধান প্রতিবেদক আশরাফ খান। এভাবে পেশায় যারা খুব পটু নন অথচ ইউনিয়ন-কর্তব্যে নিরলস, তারাই ইউনিয়ন করতে আসতেন।
সুদক্ষ সাংবাদিকরা ইউনিয়ন করার সময় পেতেন না। অন্যদিকে দেখা গেছে, ইউনিয়ন করলে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়, এই কারণে যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, এবং যারা কখনো ছাত্র রাজনীতি বা সংগঠন করেননি, এমন সব সাংবাদিক রাতারাতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক বনে যান। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকরা ইউনিয়ন নেতৃত্বে আসতে পারেননি বা তাদের আসতে দেওয়া হয়নি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েকটি ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং পত্রিকা ছিল। সাংগঠনিকভাবে যে সব প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাই করেনি, তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। ব্যক্তিগতভাবে দেলোয়ার হোসেন সাইদী, কামরুজ্জামান ও কাদের মোল্লারা গুম, হত্যা ও নির্যাতনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকলেও সাংগঠনিকভাবে তারা জড়িত ছিলেন বলেই মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। আমাদের সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কালো তালিকাভুক্ত রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় কাজ করেছেন। সাংগঠনিকভাবে এরাও সাঈদী, কাদের মোল্লা ও মুজাহিদের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ‘গুনে’ গুনান্বিত।
আমরা ১৯৬৬ সালে ৬-দফা ও ১১-দফা আন্দোলনে একাধিকবার জেল খেটেছি। হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে অংশ নিয়েছি এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমাদের নেতাদের অনেকেই তখন ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এখন তারা হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক বনে গিয়ে নেতৃত্বে এসে সব ধরনের চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র অধিকারী।
২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন জননেতা মরহুম আব্দুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন। আমাদের সাবেক এমপি মজিবুর মাস্টার ও আমি প্রায়ই রাজ্জাকভাইয়ের সংসদের চেম্বারে গিয়ে গল্প করতাম। একদিন রাজ্জাকভাই বললেন, পাকিস্তানি জমানায় রাজনীতিকরা নিজ নিজ এলাকায় নিবেদিতপ্রাণ তরুণদের পরিচর্যা করতেন। ওদের উন্নতি চাইতেন। তিনি বলেন, আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম দুই মেয়াদে। প্রথম মেয়াদে আমার সঙ্গে সভাপতি ছিলেন সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী।
দ্বিতীয় মেয়াদে সভাপতি ছিলেন আমার বন্ধু ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। ওই সময় নোয়াখালীর আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল মালেক উকিল, খাজা আহম্মদ ও তালেব আলী তাদের এলাকার কয়েকজন ছাত্রলীগারকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যভুক্তির জন্য আমাকে অনুরোধ জানান। এদের মধ্যে আমি তখন তোমাদের সাংবাদিক আবু তাহেরকে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করি। ফেরদৌস আহমদ কোরেশী চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ অনার্সে ভর্তি হন। কোরেশী আমাদের ফেলে দিয়ে আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগে যোগ দিয়ে ‘বাংলা ছাত্রলীগ’ নামে একটা সংগঠন গড়েন। তখন তোমাদের সাংবাদিক আল মুজাহিদী, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ও ইকবাল সোবহান চৌধুরী বাংলা ছাত্রলীগে যোগ দেন।
এনএসএফ এবং বাংলা ছাত্রলীগ সরকারি সমর্থক ছাত্রসংগঠন। আর তোমাদের ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ সরকারিবিরোধী প্রগতিশীল ও স্বাধীকার আন্দোলনে অংশ নেয়।
বিষয়টি এক কথায় বলা যায়, সাংবাদিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ ফোরাম হিসেবে দুভাগে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবির সবাই এবং জাসদ-বাসদ ও ওয়ার্কাস পার্টিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল সমর্থিত সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক ফোরাম হিসেবে পরিচিত। আর বিএনপি, জামায়াত, ন্যাপ ভাসানীসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী সাংবাদিকদের পৃথক আরেকটি ফোরাম রয়েছে। মজার বিষয় হল মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধিকার ও প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে কোনোদিন যুক্ত ছিলেন না, এমন কিছু লোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরামের নেতৃত্বে চলে এসেছেন। এরা একটি কোটারী নেতৃত্বে আসা এই ‘মহাজন’রা একটি কোটারি গড়ে তোলেন। কোটারিতে ‘নেতা’ হয়েছেন কারা? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নয় এবং কোন আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো দিন যুক্ত ছিলেন না এবং পরিবারের কোনো সদস্য কোনো আন্দোলন সংগ্রামের ধারে কাছেও ছিলেন না- এমন সব ব্যাক্তিরা।
এদের একটা বড় অংশকে মহাজনরা নেতৃত্বে এনে তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিশিষ্ট’ সাংবাদিক বানিয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, যেমন বিদেশ ভ্রমণ, প্লট বরাদ্দ পাওয়া এবং বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক পদায়ন এরাই বগলদাবা করেছেন। এরা ‘সাংবাদিকনেতা’-এটিই বড় পরিচয়। আন্দোলন সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা না থাকলেও সাংবাদিকনেতা বনে গিয়ে তারা একচেটিয়া সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফোরামকে যে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর কে যে বিপক্ষের তা বুঝা কঠিন। সব কিছু মিলে তালগোল পাকিয়ে তোলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফোরাম হিসেবে পরিচিত শীর্ষপর্যায়ের সাংবাদিকনেতারা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন; তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক ফোরামের দুইজন অমুক্তিযোদ্ধা শীর্ষপর্যায়ের নেতা, যারা সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। এর একজন আমাকে ইউএনএ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী করার জন্য দু-দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সফরসঙ্গী তো দূরের কথা আমেরিকার ভিসা পেতেও সহযোগিতা করেননি। আরেকজন শীর্ষনেতা দৈনিক বঙ্গবাণী পত্রিকার ফাইন্যান্সার জোগাড় করে দেওয়ার জন্য জনবল ও প্রকাশনা খরচের হিসাব তিন দফায় নিয়েছেন। দীর্ঘ তের বছরেও ফাইন্যান্সার জোগাড় করে দেননি। এসব নেতার কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর ফাড়াক। অথচ এরাই আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফোরামের সাংবাদিকনেতা!
সাংবাদিকদের দুটি প্লাটফর্ম। একটি ইউনিয়ন এবং আরেকটি প্রেসক্লাব। যারা আন্দোলন সংগ্রামে পটু এবং মালিক পক্ষের সঙ্গে সাংবাদিকদের রুটি রুজির আন্দোলন সংগ্রামে সচেষ্ট, তাদেরই সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে আসার কথা। আর যারা ইউনিয়ন পলিটিক্স করেন তারা প্রেসক্লাবের নেতৃত্বে আসবেন না এটিই সাধারণ নিয়ম ছিল। যদিও বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ফোরামের দুই শীর্ষনেতা গিয়াস কামাল চৌধুরী ও রিয়াজউদ্দিন আহমদ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হওয়ার পরও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হয়েছেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের কর্মকান্ড ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্পৃক্ত। জাতীয় প্রেসক্লাব ঢাকায় হলেও এটি জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। একজন সাধারণ সাংবাদিক, সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য হতে পারেন। আর জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য হতে হলে কমপক্ষে পাঁচ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হয়।
এ ছাড়াও ব্লাকের বলের বিধান রয়েছে। পলিটিক্স-এ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরামের দুজন সাংবাদিক নেতা প্রেসক্লাব পলিটিক্সে সবচেয়ে পপুলার। একজন স্বপন সাহা ও অন্যজন সাইফুল আলম। তবে একটি ঘটনায় স্বপন সাহা কিছুটা বিতর্কিত হয়েছেন। তিনি যখন আমাদের ফোরাম থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, সে বছর ৩৩ জন করে দুই ফোরামের ৬৬ জনকে প্রেসক্লাবের সদস্য পদ দেওয়া হয়। সে বার নেতারা যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী একটি তালিকা দিয়েছিলেন স্বপন সাহার হাতে। তিনি সিনিয়রিটির তালিকা ডিঙ্গিয়ে ভোরের কাগজের জুনিয়ার রিপোর্টার শ্যামল দত্ত, মুন্নি সাহা ও প্রণব সাহার নামে টিক চিহ্ন দিয়ে ক্লাবের কমিটি কাছে দিয়েছিলেন এবং সে অনুযায়ী তাদের সদস্য করেছিলেন। ভোরের কাগজের সম্পাদক মতিউর রহমান, বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু ও চিফ রিপোর্টার সানাউল্লাহ লাভলুকে সদস্য করা হয়নি। এ ঘটনায় স্বপন সাহা কিছুটা বিতর্কিত হয়েছেন। যে কারণে তিনি দু-দফা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও প্রেসক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হতে পারেননি।
প্রেসক্লাবে আমাদের ফোরামের সদস্য কম হওয়ার পরও স্বপন সাহা সাধারণ সম্পাদক ও সাইফুল আলম যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ দুজন ছাড়াও মাহমুদ হাসান ও রেজোয়ানুল হক রাজা প্রেসক্লাবে বেশ পপুলার। তারা দুজনই সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন আর আগের মত পপুলারিটি বিচার করা যায় না। কেন না, এখন আর বিনা দান দক্ষিণায় বৈতরণী পার হওয়া যায় না।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য আমরা অনেকেই ভারতে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে আমাদের একটি বড় অংশ প্রশিক্ষণ নিয়ে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আর কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। এই অংশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও এবং পত্রপত্রিকায় কাজ করেছেন।
আর কিছু সংখ্যক ভারতের বিভিন্ন যুব ক্যাম্প থেকে যাচাই-বাছাই করে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছেন। নেতৃস্থানীয় কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন স্থানে শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত পরিবারকে বেশন কার্ড করে দেয়া এবং তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। কতিপয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ভারতে না গিয়েও দেশের ভেতরে থেকে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, বিডিআর, আনসার ও পুলিশবাহনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক প্রায় ৩০ জন। এদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক দুজন দেশের ভেতরে প্রশিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া এবং অন্যজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শফিকুর রহমান। শাহজাহান মিয়া ইউনিয়ন নেতা এবং মুহম্মদ শফিকুর রহমান ক্লাব নেতা। এই দুজনই ক্লিন ইমেজের বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক।
মোট ৩০ জন সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে এ দুজনই দেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের শীর্ষপদ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হাবিবুর রহমান মিলন ও ইকবাল সোবহান চৌধুরীর পরে এই পদে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, আলতাফ মাহমুদ ও মোল্লা জালাল। বর্তমানে ওমর ফারুক এ পদে আছেন। শাহজাহান মিয়া, আখতার আহাম্মেদ খান ও আব্দুল জলিল ভূঁইয়া বিএফইউজের মহাসচিব পর্যন্ত হয়েছেন। এই তিনজনের মধ্যে আবদুল জলিল ভুইয়া ছাড়া বাকি দু’জন সরকারের সুবিধা পেয়েছেন। প্রেসক্লাবের সভাপতি হয়েছিলেন হাসান শাহরিয়ার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শফিকুর রহমান, সাইফুল আলম ও ফরিদা ইয়াসমিন। এর মধ্যে সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিনের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন।
লেখক, সম্পাদক, দৈনিক বঙ্গবাণী, ঢাকা
চলমান